চিরায়ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যা কিছু কোনও স্থান বা আয়তন দখল করে এবং জড়তা (বা ভর) ও মহাকর্ষ ধর্ম প্রদর্শন করে, তাকেপদার্থ বলে।[১][২] দৈনন্দিন স্পর্শযোগ্য সমস্ত বস্তু মোটামুটিভাবে শেষ বিচারে অনেকগুলিপরমাণু দিয়ে তৈরি, যেগুলি আবার পরস্পর আন্তঃক্রিয়াশীলঅতিপারমাণবিক কণা দিয়ে তৈরি। তবে ভরহীন কণা যেমনফোটন ও অন্যান্যশক্তি-সংক্রান্ত ঘটনা যেমনআলো,তাপ,চুম্বকত্ব,বিদ্যুৎ,তেজস্ক্রিয়তা, এগুলিকে পদার্থ হিসেবে গণ্য করা হয় না।[১] পদার্থ বিভিন্ন ধরনের অবস্থা বা দশায় বিরাজ করে, যেমন কঠিন, তরল কিংবা বায়বীয়।জীবদেহে অবস্থিত বা জীবদের দ্বারা উৎপাদিত বিশেষ পদার্থগুলিকেজৈব পদার্থ এবং বাকী সব পদার্থকেঅজৈব পদার্থ বলা হয়। পদার্থ ওশক্তি একত্রেমহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুনিষ্ঠ ঘটনার ভিত্তি গঠন করেছে; তবে কোনও কোনও বিজ্ঞানীর মতেতথ্য পদার্থ ও শক্তির চেয়েও মৌলিক একটি ধারণা।
রসায়নবিদ্যায় পদার্থকেমৌলিক পদার্থ (যাকে রাসায়নিকভাবে সরলতর উপাদানে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়) ওযৌগিক পদার্থ (যাকে রাসায়নিকভাবে সরলতর উপাদানে তথা মৌলিক পদার্থে বিশ্লেষণ করা সম্ভব) - এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। মৌলিক পদার্থগুলি একে অপরের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে যৌগিক পদার্থ গঠন করে। এ পর্যন্ত একশতের বেশি (১১৮ টি) মৌলিক পদার্থ শনাক্ত করা হয়েছে। মৌলিক পদার্থগুলিকেধাতু,অধাতু,ধাতুকল্প, ইত্যাদি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ উভয়েই নির্ভরযোগ্যভাবে সুনির্দিষ্ট ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলি প্রদর্শন করে। প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ মৌলিক বা যৌগিক পদার্থ সাধারণত পাওয়া যায় না। এগুলি সাধারণতসমসত্ত্ব বা অসমসত্ত্বমিশ্র পদার্থ হিসেবে বিরাজ করে; মিশ্র পদার্থগুলির কোন নির্দিষ্ট নির্ভরযোগ্য রাসায়নিক ধর্ম নেই। এছাড়া পৃথিবীতেকার্বন নামের মৌলক পদার্থটিহাইড্রোজেন,অক্সিজেন,নাইট্রোজেন,গন্ধক ওফসফরাসের সাথে মিলে বহুসংখ্যকজৈব যৌগিক পদার্থ গঠন করেছে যেগুলিজীবনের ভিত্তি বাজীবদের দ্বারা উৎপাদিত হয়। (শৃঙখল গঠন দেখুন)
আধুনিক কণাভিত্তিকপদার্থবিজ্ঞানের মান তত্ত্বে পদার্থকে বিপুল সংখ্যকঅণু ওপরমাণুর সমষ্টি হিসেবে কল্পনা করা হয়। পরমাণু হল মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক ধর্মাবলি প্রদর্শনকারী ক্ষুদ্রতম একক। পরমাণুর অভ্যন্তরে ধনাত্মক আধানেরপ্রোটন ও আধানহীননিউট্রন কণা নিয়ে গঠিত একটিপরমাণুকেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস থাকে এবং একে ঘিরে "আবর্তনশীল" ঋণাত্মক আধানেরইলেকট্রন কণাসমূহের একটি "মেঘ" থাকে যা পরমাণুটির "দখলকৃত স্থান" বা আয়তন নির্ধারণ করে।[৩][৪] পরমাণুর অভ্যন্তরের প্রোটন কণার সংখ্যা কোনও মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম নির্ধারণ করে। পরমাণুগুলি একে অপরের সাথেতড়িৎযোজী,সমযোজী,সন্নিবেশ,ধাতব, ইত্যাদিরাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্থিতিশীল মৌলিক বা যৌগিক অণু গঠন করে। অণুগুলি আবার বিভিন্ন ধরনেরআন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা পরীক্ষাগারে পর্যবেক্ষণযোগ্য স্থূল পদার্থ তৈরি করে, যেগুলি বিভিন্নঅবস্থা বাদশায় বিরাজ করতে পারে (কঠিন,তরল,বায়বীয়, ইত্যাদি)।
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ীশক্তি (পদার্থেরকাজ সম্পাদন বাতাপ উৎপাদন করার ক্ষমতা) ও পদার্থ দুইটি পৃথক সত্তা যারা একত্রে সমস্ত বাস্তব ভৌত ঘটনার ভিত্তি গঠন করেছে। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে (বিশেষ আপেক্ষিকতা) পদার্থ ও শক্তি একটি অন্যটিতে রূপান্তরযোগ্য, সুতরাং এগুলি একই সত্তার দুই ভিন্ন রূপ। তবে গতি, তরল ও বায়বীয় পদার্থের আচরণ, তাপ, ইত্যাদিসহ আরও বহু ঘটনার সরল ব্যাখ্যা দেয়ার স্বার্থে বিজ্ঞানীরা পদার্থ ও শক্তিকে দুইটি আলাদা সত্তা হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন।
উপরে সংজ্ঞায়িত পদার্থ পর্যবেক্ষণযোগ্য সমস্ত ভৌত বস্তু তথা জ্ঞাত মহাবিশ্বকে গঠনকারী প্রধান উপাদানগুলির একটি। এগুলিকেব্যারিয়নজাত পদার্থ বলে।ব্যারিয়ন বলতে প্রোটন, নিউট্রন, পরমাণু তথা তিনটি কোয়ার্ক নিয়ে গঠিত যেকোনও কণাকে বোঝায়। ব্যারিয়নজাত পদার্থকে "সাধারণ পদার্থ" নামেও ডাকা হয়।কণা পদার্থবিজ্ঞানের আদর্শ মডেলে বা প্রতিমায় এগুলি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
তবে মহাবিশ্বের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই (প্রায় ৯৫%)তমোপদার্থ ওতমোশক্তি নামের অজ্ঞাত উপাদান দিয়ে গঠিত, যাদের প্রকৃতি সম্বন্ধে খুব বেশি এখনও জানা সম্ভব হয়নি। তমোপদার্থ হল অজানা গঠনের এক ধরনের পদার্থ যা কোন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ বা প্রতিফলন করে না, এবং সে কারণে একে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না, কিন্তু দৃশ্যমান পর্যবেক্ষণযোগ্য পদার্থের উপর এর মহাকর্ষীয় প্রভাবের মাধ্যমে এর উপস্থিতি অনুমান করা সম্ভব।[৫][৬] বিজ্ঞানীরা সাধারণভাবে একমত যে তমোপদার্থ ব্যারিয়ন (তথা এ পর্যন্ত জানা কোনও অতিপারমাণবিক কণা) দিয়ে গঠিত নয়।[৫] কোনও কোনও বিজ্ঞানীর মতে এগুলি কিছু অতি-প্রতিসাম্য কণা,[৭] যারা পরমাণুর আদর্শ মডেলে প্রস্তাবিত কণাগুলির মত নয়। বরং এগুলি মহাবিশ্বের প্রাথমিক দশাতে অত্যন্ত উচ্চ শক্তি নিয়ে গঠিত হয়েছিল এবং এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে।[৫]
আবার যে বিকর্ষণকারী প্রভাবের কারণে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার ত্বরান্বিত হচ্ছে, তার উৎসকে তমোশক্তি নাম দেওয়া হয়েছে। তমোশক্তির মূল প্রকৃতি এখনও অজানা, তবে শক্তি ঘনত্ব এবং শূন্যস্থানের প্রতি চাপ, ইত্যাদি পদার্থ-জাতীয় ধর্ম দিয়ে এর প্রভাবগুলির একটি মডেল বা প্রতিমা নির্মাণ করা সম্ভব।[৮][৯]
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে মানবনির্মিত সেরাদূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দৃশ্যমান বিশ্বের মাত্র ৪.৬% ব্যারিয়নজাত পদার্থ দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে প্রায় ২৬.৮% তমোপদার্থ এবং প্রায় ৬৮.৩% তমোশক্তি।[১০] অর্থাৎ পদার্থের গঠন-সংক্রান্ত কণা পদার্থবিজ্ঞানের আদর্শ মডেল দিয়ে বিদ্যমান মহাবিশ্বের মাত্র ২০ ভাগের এক ভাগ পদার্থ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে। বাকী প্রায় ৯৫% পদার্থ সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানা যায়নি।[৯]
বিজ্ঞানীরা আরও মনে করেন যে তাত্ত্বিকভাবে মহাবিশ্বে সমপরিমাণ পদার্থ ওপ্রতি-পদার্থ বিদ্যমান। প্রতি-পদার্থের কণাগুলি পদার্থের কণার সংস্পর্শে আসলে এগুলি একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে প্রতি-পদার্থ অত্যন্ত বিরল। প্রতি-পদার্থের এই অনুপস্থিতি বা বিরলতা বর্তমান পদার্থবিজ্ঞানের এক বিরাট অমীমাংসিত সমস্যা।
স্থুল দৃশ্যমান, স্পর্শনযোগ্য বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থ ভিন্ন ভিন্ন সমগ্রীভূত অবস্থায় থাকতে পারে যাদেরকে পদার্থের দশা বলা হয়,[১১] যা পদার্থের পারিপার্শ্বিক চাপ, তাপমাত্রা ও আয়তনের উপর নির্ভরশীল।[১২] পদার্থের দশা হল এর এমন একটি সমগ্রীভূত রূপ যাতে এর রাসায়নিক গঠন ও ভৌত ধর্মাবলি (ঘনত্ব, আপেক্ষিক তাপ,প্রতিসরাঙ্ক, ইত্যাদি) মোটামুটি একই রকম হয়। সবচেয়ে পরিচিত তিনটি দশা হল কঠিন, তরল ও বায়বীয় দশা। এগুলিকে চিরায়তভাবে পদার্থের অবস্থাও বলা হয়। যেমন হাইড্রোজেন অক্সাইড নামক যৌগিক পদার্থটি শূন্যের নিচের তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় (বরফ), সাধারণ তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় (পানি) এবং ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উঁচু তাপমাত্রায় বায়বীয় অবস্থায় (জলীয় বাষ্প) বিরাজ করে। এই অবস্থাগুলি মূলত কয়েকটি ধর্ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। কঠিন পদার্থের নির্দিষ্ট আয়তন ও আকৃতি থাকে। তরল পদার্থের নির্দিষ্ট আয়তন থাকলেও এটির নির্দিষ্ট আকৃতি নেই; যে পাত্রে রাখা হয়, এটি সেই পাত্রের আকৃতি ধারণ করে। আর বায়বীয় পদার্থের কোন নির্দিষ্ট আয়তন বা আকৃতি কোনটিই নেই; এটি বদ্ধ পাত্রের সমস্ত আয়তন দখল করতে চেষ্টা করে। পদার্থের এই অবস্থাগুলিকে আরও কিছু উপ-অবস্থায় শ্রেণীকরণ করা যায়। যেমন কঠিন পদার্থকে স্ফটিকনির্মিত বা স্ফটিকহীন এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। অথবা এগুলিকে পরমাণুগুলির মধ্যকার বন্ধনের উপর ভিত্তি করে ধাতব, আধানযুক্ত, সমযোজী বা আণবিক ইত্যাদি কঠিন পদার্থে ভাগ করা যায়।
পদার্থের কিছু দশা পরিষ্কার করে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়, যেমন প্লাজমা দশা। বায়বীয় পদার্থ খুবই উচ্চ তাপমাত্রায় আয়নিত হলে এই দশায় বিরাজ করে। ফেনা দশায় পদার্থ একই সাথে তরল ও কঠিন পদার্থের কিছু ধর্ম প্রদর্শন করে। গুচ্ছ দশায় স্বল্পসংখ্যক পরমাণু বা অণু একত্রিত হয়ে একই সাথে পারমাণবিক-পর্যায়ের ও স্থুল পদার্থের ধর্ম প্রদর্শন করে। এছাড়া তরল স্ফটিক, অতিপ্রবাহী, অতিকঠিন, বসু-আইনস্টাইনঘনীভবন উৎপাদ, পরাচুম্বক, অয়শ্চুম্বক, ফার্মিয়নীয় ঘনীভবন উৎপাদ, কোয়ার্ক-গ্লুঅন প্লাজমা, ইত্যাদি আরও অনেক ব্যতিক্রমী বা "উদ্ভট" দশা আছে।[১৩]
পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে পদার্থ এক দশা থেকে আরেক দশায় রূপান্তরিত হয়, যাকে দশান্তর বলে। দশান্তরগুলিতাপগতিবিজ্ঞান নামক উপক্ষেত্রে আলোচনা করা হয়। এছাড়া ন্যানোবস্তুসমূহে আয়তনের তুলনায় পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল অত্যন্ত বেশি হয় বলে পদার্থের এমন সব ধর্ম পরিলক্ষিত হয়, যেগুলি স্থুল পদার্থের কোনও দশা দিয়েই সন্তোষজনকভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
সব ধরনের পদার্থ জড়তা নামের একটি মৌলিক ধর্মের অধিকারী। নিউটনের গতিসংক্রান্ত তিনটি বিধি অনুযায়ী জড়তা হল পদার্থের সেই ধর্ম যার কারণে বাইরে থেকে এর স্থিতিশীল বা গতিশীল অবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করলে পদার্থটি তৎক্ষণাৎ অবস্থা পরিবর্তন করে না। পদার্থের এই জড়তা ধর্মটিকে যে রাশির সাহায্যে পরিমাপ করা হয়, সেটিকে তার ভর বলে। জড়তার কারণে একটি সাইকেলকে ঠেলা দেওয়া সহজ, কিন্তু একটি গাড়িকে ঠেলা দেওয়া অনেক কঠিন। পদার্থের আরেকটি সার্বজনীন ধর্ম হল মহাকর্ষীয় ভর। এটি মহাবিশ্বের প্রতিটি ভৌত সত্তা বা বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করার ঘটনাটিকে পরিমাপে সাহায্য করে। প্রথমে আইজাক নিউটন ও পরে আলবার্ট আইনস্টাইন এ ব্যাপারে তত্ত্ব দেন।
পদার্থের অণুসমূহের ধর্ম, তাদের বিস্তার ও বিন্যাস পদার্থের আরও অনেক ধর্ম নির্ধারণ করে, যেমন- কাঠিন্য, সান্দ্রতা, প্রবহমানতা, বর্ণ, স্বাদ, গন্ধ, তাপ ও বিদ্য্যুৎ পরিবাহিতা বা রোধকতা, ইত্যাদি। পদার্থকে তাই বিভিন্ন ধর্মের মাধ্যমে শনাক্ত ও চরিত্রায়িত করা যায়। পদার্থের যেসব ধর্ম সেটির কোনওরাসায়নিক পরিবর্তন সাধন না করেই পর্যবেক্ষণ ও নির্ণয় করা যায়, সেগুলিকে পদার্থেরভৌত ধর্ম বলে। অন্যদিকে পদার্থের যেসব ধর্ম সেটির রাসায়নিক চরিত্রের পরিবর্তন সাধন করার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও নির্ণয় করতে হয়, সেগুলিকে পদার্থেররাসায়নিক ধর্ম বলে, যেমনবিক্রিয়াশীলতা,দাহ্যতা,দহন তাপ,জারণ ক্ষমতা, ইত্যাদি। ভৌত ধর্মগুলিকে আবার দুই প্রকারে ভাগ করা যায়। যেসব ভৌত ধর্ম পদার্থের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল, সেগুলিকেবিকীর্ণ বা পরিমাণগত ধর্ম বলে, যেমনভর,আয়তন,ওজন, ইত্যাদি। অন্যদিকে যেসব ভৌত ধর্ম পদার্থের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল নয়, সেগুলিকে পদার্থেরসংকীর্ণ ধর্ম বলে, যেমনঘনত্ব,বর্ণ,গন্ধ, নমনীয়তা বাঘাতসহিষ্ণুতা,তাপ পরিবাহিতা,তড়িৎ পরিবাহিতা,দ্যুতি,প্রসার্যতা,স্ফুটন বিন্দু,গলন বিন্দু, ইত্যাদি।
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি পদার্থের পারমাণবিক গঠনের মান বা আদর্শ তত্ত্বটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে গাঠনিকভাবে সমস্ত পদার্থকোয়ার্ক ওলেপটন নামের দুই শ্রেণীর অবিভাজ্য মৌলিকঅতিপারমাণবিক কণা নিয়ে গঠিত। কোয়ার্ক ও লেপটন কণাগুলিকে “পদার্থ কণা” এবংফার্মিয়ন নামেও ডাকা হয়। এ পর্যন্ত ৬ ধরনের কোয়ার্ক ও ৬ ধরনের লেপটন কণা আবিষ্কৃত হয়েছে।
কোয়ার্ক ও লেপটনগুলি মধ্যস্থতাকারী কিছু কণার সাহায্যে সংযুক্ত হয়েপ্রোটন ওনিউট্রন নামের যৌগিক কণা গঠন করে, যাদেরকেনিউক্লিয়ন বলা হয়। মধ্যস্থতাকারী কণিকগুলি চারটি মৌলিক নিউক্লীয় আন্তঃক্রিয়া বলের বাহক হিসেবে কাজ করে। সবল নিউক্লীয় বলের বাহক হিসেবেগ্লুঅন (ভরহীন), দুর্বল নিউক্লীয় বলের বাহক হিসেবে তিন ধরনেরবোসন (ভরযুক্ত), নিউক্লীয় তড়িচ্চুম্বকীয় বলের বাহক হিসেবেফোটন (ভরহীন) নামক কণা শনাক্ত করা হয়েছে। নিউক্লীয় মহাকর্ষ বলের জন্য কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানেগ্রাভিটন নামক একটি ভরহীন কণা প্রস্তাব করা হলেও এর অস্তিত্ব এখনও প্রমাণিত হয়নি।
প্রোটন ও নিউট্রনগুলি একত্রিত হয়ে ধনাত্মক আধানবিশিষ্টপরমাণুকেন্দ্র তৈরি করে। এই অতিক্ষুদ্র কিন্তু পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভরবিশিষ্ট পরমাণুকেন্দ্রটি এবং একে ঘিরে ঘূর্ণায়মান ঋণাত্মক আধানবিশিষ্টব কিন্তু অত্যন্ত অল্প ভরবিশিষ্ট ইলেকট্রন কণার মেঘ একত্রে মিলে নির্দিষ্ট আয়তনবিশিষ্ট পরমাণু গঠন করে। ইলেকট্রনগুলি লেপটন শ্রেণীর মৌলিক অতিপারমাণবিক কণা।
পরমাণুর বেশিরভাগ আয়তনই শূন্যস্থান; পরমাণুকেন্দ্রের আয়তন মোট পরমাণুর আয়তনের প্রায় ১ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। পরমাণুসমূহের ব্যাস সাধারণত অ্যাংস্ট্রম এককে মাপা হয় (১ মিটারের ১ হাজার কোটি ভাগের এক ভাগ)।
পরমাণুকেন্দ্রে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পরমাণু হয়, যেগুলি একেকটি মৌলিক পদার্থ গঠন করে। একই মৌলিক পদার্থের সব পরমাণু একই রাসায়নিক ধর্ম প্রদর্শন করে। মৌলিক পদার্থগুলির পর্যায় সারণিতে এগুলিকে প্রোটন সংখ্যা এবং অন্যান্য ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যস্ত করা হয়েছে। একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন নিয়ে গঠিত হাইড্রোজেন পরমাণু সবচেয়ে সরল, ক্ষুদ্র ও কম ভরবিশিষ্ট পরমাণু। সবচেয়ে ভারী পরমাণুতে (মানবনির্মিত ও কৃত্রিম) একশতর বেশি প্রোটন থাকতে পারে।
একাধিক পরমাণু সাধারণত সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে অথবা তড়িৎযোজী বন্ধনে বিপরীত বৈদ্যুতিক আয়নরূপে আবদ্ধ হয়ে পদার্থের অণু গঠন করে। বিপুল সংখ্যক পরমাণু ও অণু একত্রিত হলে দৈনন্দিন জীবনে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিভিন্ন স্থূল মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ গঠিত হয়।
ইলেকট্রন কণাগুলির কোন নির্দিষ্ট অবস্থান নেই। এগুলি পরমাণুতে পারমাণবিক কক্ষপথে বা যৌগিক পদার্থের অণুতে আণবিক কক্ষপথে খোলক বা মেঘের আকারে চলাচল করে। কঠিন পদার্থে ইলেকট্রন পদার্থের মোট আয়তন জুড়েইআপাত-কণিকা (Quasi-particle) হিসেবে চলমান থাকতে পারে।
তবে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থের গঠন সংক্রান্ত উপর্যুক্ত বর্ণনাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পদার্থ কোন সুসংজ্ঞায়িত মৌলিক ধারণা হতে পারে না। কেননা পদার্থকে গঠনকারী পরমাণু তথা অতিপারমাণবিক কণিকাগুলির কোন নিজস্ব আকার বা আয়তন নেই। অতিপারমাণবিক কণাগুলি প্রকৃতপক্ষে সাধারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অতিক্ষুদ্র বিন্দুসদৃশ সংস্করণ নয়। এদের ধর্মগুলি কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা দৈনন্দিন বস্তুগুলির আচরণ থেকে আলাদা। এগুলি একই সাথে কণা ওতরঙ্গের মতো আচরণ করে এবংপাউলির বর্জন নীতি ও অন্যান্য মৌলিক আন্তঃক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে একে অপরের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে। এর ফলে মানুষের ইন্দ্রিয়ের কাছে পদার্থের “আয়তন” ধর্মটি প্রতিভাত হয় এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পদার্থ স্থান দখল করে আছে। প্রকৃতপক্ষে একটি অতিপারমাণবিক কণা (যেমন প্রোটন) কোন স্পর্শনযোগ্য, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কণা নয়, বরং সমগ্র মহাবিশ্বব্যাপী সীমাহীন বিস্তৃত প্রোটন ক্ষেত্রের একটি স্থানীয় কোয়ান্টামীয় স্পন্দন মাত্র। একইভাবে আমাদের জানা সবধরনের অতিপারমাণবিক কণার জন্যই মহাবিশ্বের সমগ্র ব্যপ্তি জুড়ে অতিবৃহৎ অসীম ক্ষেত্র আছে, যেগুলির স্থানীয় কোয়ান্টামীয় স্পন্দনকে আমরা বিভিন্ন কণা হিসেবে চিহ্নিত করি। এই বহুসংখ্যক কোয়ান্টামীয় স্পন্দনশীল অতিপারমাণবিক ক্ষেত্রসমূহের আন্তঃক্রিয়ার সামগ্রিক ফলাফলই হল মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটিই হল পদার্থ সম্পর্কে আজ অবধি মানুষের গভীরতম উপলব্ধি।
কোনও কোনও বিজ্ঞানীর মতে অতিপারমাণবিক কণিকাগুলির সমস্ত বৈশিষ্ট্য তথ্যের আকারে এবং এই তথ্যকে দ্বিমিক বা বাইনারি সংকেত (০ বা ১) আকারে প্রকাশ করা সম্ভব। সুতরাং সমগ্র মহাবিশ্বকে দ্বিমিক সংকেত প্রক্রিয়াজাতকারী এক দানবীয় অতিবিশাল গণকযন্ত্র তথা সুপারকম্পিউটার হিসেবে কল্পনা করা সম্ভব। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন আর্চিবল্ড হুইলার ("কৃষ্ণগহ্বর" পরিভাষার প্রবর্তক) তার কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে তথ্যের মাধ্যমে মহাবিশ্বের গঠন ব্যাখ্যার এক বড় সমর্থকে পরিণত হন। তার মতে মহাবিশ্বকে তিনভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব। প্রথমত, মহাবিশ্বের সবকিছুই হল কণা। দ্বিতীয়ত মহাবিশ্বের সবকিছুই হল বিভিন্ন কোয়ান্টাম ক্ষেত্র ও তাদের আন্তঃক্রিয়া। তৃতীয়ত, মহাবিশ্বের সবকিছুই হল তথ্য। ১৯৮০-র দশকে হুইলারতথ্য তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করেন এবং ১৯৮৯ সালে একটি গবেষণাপত্রে লেখেন যে "যা কিছু আছে – সব কণা, সব বলক্ষেত্র, এমনকিস্থান-কাল পরম্পরার উদ্দেশ্য, অর্থ ও সমগ্র অস্তিত্ব – কোন কোন ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে হলেও – কিছু হ্যাঁ/না-জাতীয় প্রশ্নের উত্তরের উপর, তথা দ্বিমিক নির্বাচন, তথা বিটের উপর নির্ভরশীল।" অন্য ভাষায় মহাবিশ্ব এর ভেতরে নিহিত দ্বিমিক তথ্যের থেকে উৎসারিত হয়। হুইলার এ ব্যাপারটিকে সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্মরণীয় একটি ইংরেজি খণ্ডবাক্য দিয়ে প্রকাশ করেন— “ইট ফ্রম বিট” ("It from bit")। "ইট" হল সব পদার্থ আর "বিট" হল "দ্বিমিক বা বাইনারি সংকেত"।[১৪]
প্রাচীন ভারতীয় ঋগ্বেদীয় দর্শন অনুযায়ী মহাবিশ্বশুদ্ধ তত্ত্ব,শুদ্ধাশুদ্ধ তত্ত্ব এবংঅশুদ্ধ তত্ত্ব—এই তিন ধরনের উপাদান নিয়ে গঠিত। সব মিলিয়ে এদের সংখ্যা ৩৬টি পর্যন্ত হতে পারে (শৈব দর্শন অনুযায়ী)। শুদ্ধ ও শুদ্ধাশুদ্ধ তত্ত্বগুলি পরম উপাদান ও আত্মার গঠনের সাথে সম্পর্কিত। অন্যদিকে অশুদ্ধ তত্ত্বগুলি বাস্তব বিশ্ব ও মানুষের দেহ গঠন করেছে। এদের মধ্যে আছেপঞ্চমহাভূত বা পাঁচ ধরনের স্থুল পদার্থ; এগুলি হলো পৃথিবী, অপ্ বা জল, তেজ বা অগ্নি, বায়ু ও আকাশ (শূন্যস্থান)। এই পাঁচটি মহাপদার্থ বিভিন্ন অনুপাতে মিলে মহাবিশ্বের সবকিছু গঠন করছে। মানুষ পদার্থকে সম্পূর্ণরূপে কখনোই উপলব্ধি করতে পারে না। মানুষ পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের (ঘ্রাণ, রসনা, চক্ষু, ত্বক ও শ্রোত্র) সাহায্যে স্থুল পদার্থের পাঁচটি তন্মাত্র বা সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য (অর্থাৎ গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ) উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু এগুলি পদার্থ সম্বন্ধে সীমিত কিছু তথ্যের যোগান দেয়। চার্বাক দর্শনে ও বৌদ্ধ দর্শনে আকাশ বা শূন্যস্থানকে বাদ দিয়ে বাকী চারটি মহাভূতকে মৌলিক পদার্থ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ নাগাদ চীনের প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ৎসৌ ইয়ান বলেন যে পদার্থ পাঁচটি মৌলিক রূপান্তরযোগ্য দশা (উশি) নিয়ে গঠিত, যেগুলি হল ধাতু, কাঠ, জল, আগুন ও মৃত্তিকা বা পৃথিবী। এগুলি আবার দুইটি বিপরীতমুখী শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় (ইন ও ইয়াং)। মৌলিক দশাগুলি আবার একই শক্তি ছি-র পাঁচটি ভিন্ন রূপ।[১৫]
আনুমানিক ৫৮৫ খিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিকমিলেতুসের থালেস তরল পানি, কঠিন বরফ ও বায়বীয় জলীয় বাষ্প পর্যবেক্ষণ করে এই বিশ্বাসে উপনীত হন যে সমস্ত পদার্থ পানি দিয়ে গঠিত। এর দুই প্রজন্ম পরেআনাক্সিমেনেস যুক্তি দেন যে বায়ু ঘনীভূত হলে কুয়াশা হয়, এবং সেখান থেকে বৃষ্টি হয়, এবং শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে শিলার জন্ম হয়, তাই বাতাসই সমস্ত পদার্থের মূল উপাদান।
আনুমানিক ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক প্রাকৃতিক দার্শনিকএম্পেদোক্লেস প্রস্তাব করেন যে সমস্ত বস্তু বা পদার্থ চারটি মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত। এগুলি হল মাটি, বাতাস, আগুন ও পানি; এবং এগুলি একত্রিত হয়ে তাপ, শৈত্য, শুষ্কতা, আর্দ্রতা ইত্যাদি ধর্মের জন্ম দেয় এবং সেখান থেকেই সমস্ত পদার্থের উৎপত্তি হয়। এম্পোদেক্লেস চিকিৎসক ও কবিও ছিলেন। তার মতে উপরের চারটি মূল উপাদানকে যে শক্তি একত্রে ধরে রেখেছে, তা হল ভালবাসা। আর যে শক্তি এগুলিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে, তা হল যুদ্ধ। ভালবাসা ও যুদ্ধের মধ্যকার টানাপোড়েনের মাধ্যমেই বিশ্বের সব পদার্থ গঠিত হয়েছে। এম্পেদোক্লেসের এই পদার্থ সম্পর্কে ইউরোপীয় ধ্যানধারণাকে বহু শতাব্দী যাবৎ প্রভাবিত করে রাখে। পরে ১৬শ-১৭শ শতকে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের পরে এই ধারণা পরিত্যক্ত হয়।
আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরেক গ্রিক প্রাকৃতিক দার্শনিক আবদেরারদেমোক্রিতুস প্রস্তাব করেন যে সব পদার্থ অত্যন্ত ক্ষুদ্র কণাসদৃশ পরমাণু নামক অবিভাজ্য একক দিয়ে গঠিত। দেমোক্রিতুস সম্ভবত তার শিক্ষকলেউকিপ্পুসের কাছ থেকে এই ধারণাটি পান। দেমোক্রিতুস মনে করতেন কোনও পদার্থের পরমাণুর ভৌত ধর্ম পদার্থটির মতই হবে; যেমন লোহার পরমাণু হবে লোহার মত কঠিন ও শক্ত, আর পানির "পরমাণু" হবে মসৃণ ও পিচ্ছিল। তার প্রায় একশত বছর পরে ৩০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিকএপিকুরুস দেমোক্রিতুসের পরমাণু তত্ত্বকে সমর্থন দেন।
ধ্রুপদী-উত্তর যুগে ইসলামি চিন্তাবিদদের আলোচনায় পদার্থ
রাসাইল আল-ইখওয়ান আস-সাফা ("পবিত্র ভ্রাতৃসংঘের পত্রসমূহ") ১০ম বা ১১শ শতকে মধ্যপ্রাচ্যের (বর্তমান ইরাকের)বসরা শহরকেন্দ্রিক কিছু অজ্ঞাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদদের লেখা ৫২টি দার্শনিক পত্র নিয়ে গঠিত ও ৪ খণ্ডে বিভক্ত একটি বিশ্বকোষ যার ২য় খণ্ডে ইসলামী দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের মতে একেশ্বর বা আল্লাহ প্রথমে অনন্য একটিমাত্র বুদ্ধিমান সত্তার (আল-আগ্ল) "আদিবুদ্ধি" সৃষ্টি করেন। এই অনন্য বুদ্ধিমান সত্তা থেকে "বিশ্বাত্মা"-র (আল নাফস আল কুল্লিয়া) সৃষ্টি হয়, যার প্রকৃতি সরল। অনন্য বুদ্ধিমান সত্তা এরপর বিশ্বাত্মা থেকে "আদি জড়" (আত্মিক প্রকৃতির) সৃষ্টি করে, যার নাম আল-হাইয়ুলা আল-উলা (যার সাথে আরিস্তোতলীয় গ্রিক দর্শনের "হাইলে"-র মিল আছে)। আদি জড় যখন ভৌত রূপ ধারণ করে, তখন তাকে বলে সার্বজনীন পদার্থ বা পরম বস্তু (আল-জিসম আল-মুতলাক)। এই সার্বজনীন পদার্থ বা পরম বস্তুই হল আমাদের ভৌত মহাবিশ্বের ভিত্তি। ভৌত মহাবিশ্ব সাতটি গোলক নিয়ে গঠিত যেগুলি হল শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল, সূর্য, শুক্র, বুধ ও চন্দ্রের অধীন সাতটি গোলক। গোলকগুলি ইথারের মত একটি পদার্থ নিয়ে গঠিত, যার কোনও ক্ষয় নেই। পৃথিবী চন্দ্রের গোলকের অধীনে অবস্থিত এবং এর সবকিছু আগুন, বায়ু, পানি ও মাটি - এই চারটি মৌলিক প্রাকৃতিক পদার্থ নিয়ে গঠিত, যাদের ক্ষয় ও পরিবর্তন হয়। মৌলিক প্রাকৃতিক পদার্থগুলি সার্বজনীন পদার্থের চারটি ভিন্ন রূপ। মৌলিক প্রাকৃতিক পদার্থগুলি আবার তিন ধরনের যৌগিক বা জটিল প্রাকৃতিক পদার্থের শ্রেণী গঠন করেছে যেগুলি হল খনিজ, প্রাণী ও উদ্ভিদ। প্রাকৃতিক পদার্থগুলি আবার শেষ পর্যন্ত "কারিগরি পদার্থ" তৈরি করেছে, যেগুলি নিয়ে মানুষ কারিগরি কাজ করে। যেমন খাট তৈরি করতে উদ্ভিজ্জ কাঠ লাগে, এখানে কাঠ একটি "কারিগরি পদার্থ"। আবার কাঠ প্রকৃতিতে একটি "প্রাকৃতিক পদার্থ" হিসেবে পাওয়া যায়, যেটি আবার চারটি মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, যেগুলি আবার সর্বপদার্থ থেকে উৎসারিত হয়েছে।[১৬][১৭] ভ্রাতৃসংঘের পদার্থ বিষয়ক এই মতবাদ মূলত গ্রিক দার্শনিক আরিস্তোতলীয় মতের উপরে প্রতিষ্ঠিত।[১৮]
গ্রিক চিন্তাধারার প্রায় ২ হাজার বছর পরে, ১৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি দার্শনিকপিয়ের গাসঁদি এপিকুরুসের রচনা পড়ে আবারও একটি পারমাণবিক তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। ১৬৬১ সালেরবার্ট বয়েল মৌলিক পদার্থের সংজ্ঞা দেন। ১৮০৩ সালেজন ডালটন তার নিজস্ব পারমাণবিক তত্ত্ব দেন, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলি ভিন্ন ভিন্ন ভরের হয়।
১৭শ ও ১৮শ শতকে ইংরেজ বিজ্ঞানীআইজাক নিউটন তাররুলস অফ রিজনিং ইন ফিলসফি গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লেখেন যে স্থান দখল, কাঠিন্য, অভেদ্যতা, গতি ও জড়তা হল পদার্থের সার্বজনীন কিছু বৈশিষ্ট্য।[১৯] এরপরেঅপটিকস গ্রন্থে তিনি পদার্থকে "কঠিন, ভরযুক্ত, শক্ত, অভেদ্য, গতিশীল কণিকা...যে কণাগুলি কখনও ভাঙা যায় না" এরকম কিছু হিসেবে কল্পনা করেন।[২০]
১৯শ শতকের শেষে ও ২০শ শতকের প্রারম্ভে এসে বিজ্ঞানীরা পদার্থ সম্পর্কে আরও গভীর উপলব্ধি লাভ করেন। ১৮৬৯ সালেদিমিত্রি মেন্দেলিয়েভ সেসময় জ্ঞাত সমস্ত মৌলিক পদার্থকে তাদের সাধারণ ধর্মের ভিত্তিতে একটি পর্যায় সারণিতে শ্রেণীবিন্যস্ত করে। ১৮৯৭ সালেজোসেফ জন টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন এবং ১৯০৩ সালে তিনি তার “কিশমিশের পুডিং” নামের পরমাণু আদলটি প্রস্তাব করেন, যেখানে ধনাত্মক আধানের পরমাণুর মধ্যে ঋণাত্মক ইলেকট্রনগুলি গ্রথিত থাকে। একই বছরে জাপানি পদার্থবিজ্ঞানীহানতারো নাগাওকা পরমাণুর "শনিগ্রহ আদল" প্রস্তাব করেন যেখানে একটি পরমাণু কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসের চারদিকে বলয়ের মত বহু ইলেকট্রন ঘুরছে। ১৯১১ সালেআর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস পরীক্ষাগারে শনাক্ত করেন। ১৯১৩ সালেনিলস বোর পরমাণুর যে আদল প্রস্তাব করেন তাতে ইলেকট্রনগুলি একাধিক কোয়ান্টাম সংখ্যা দ্বারা সংজ্ঞায়িত বিভিন্ন নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরমাণুকেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসকে আবর্তন করে।
১৯০৫ সালেআলবার্ট আইনস্টাইনেরবিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রমাণ করে যে পদার্থের ভর এবং শক্তি একে অপরের সাথে রূপান্তরযোগ্য, যা বিখ্যাত E = mc2 সমীকরণটি দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব। এখানে E হল শক্তি, m হল ভর, এবং c হল আলোর দ্রুতি। যেমননিউক্লীয় বিদারণ বিক্রিয়াতে এই রূপান্তরটি ঘটে। এক্ষেত্রে একটি ভারী মৌলিক পদার্থের পরমাণুকেন্দ্র যেমনইউরেনিয়াম পরমাণুকেন্দ্র বিভক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর মোট ভরবিশিষ্ট দুইটি ভগ্নাংশে বিভক্ত হয়ে যায়। ইউরেনিয়াম পরমাণুর ভর ও ভগ্নাংশদ্বয়ের মোট ভরের মধ্যকার যে পার্থক্য, সেটি শক্তি রূপে বিকীর্ণ হয়। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনেরমহাকর্ষ সম্পর্কিত তত্ত্বে (যাসাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নামেও পরিচিত) জড়তাভিত্তিক ভর এবং মহাকর্ষীয় ভরের পর্যবেক্ষণকৃত সমতাকে কেন্দ্রীয় একটি উপপাদ্য ধরে নিয়ে দেখানো হয় যে পদার্থ তার আশেপাশের স্থান-কাল পরম্পরায় যে বিকৃতির সৃষ্টি করে, তা থেকেই মহাকর্ষের উদ্ভব ঘটে।
কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান পদার্থের ধারণাটিকে আরও জটিলতা দান করেছে। ১৯০০ সালেমাক্স প্লাংক উত্তপ্ত বস্তুর দ্বারা বিকীর্ণ তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের ধর্ম ব্যাখ্যা করতে গেলে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের সূচনা হয়। কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান অনুযায়ী অতিপারমাণবিক কণিকাগুলি একই সাথে অত্যন্ত ক্ষুদ্র কিছু গোলকের মত এবং স্থানের মধ্যে প্রসারিত তরঙ্গের মত আচরণ করে। এই আপাত অসঙ্গতি এখনও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি।
১৯৩০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণগুলির কারণে পদার্থের সংজ্ঞা আরও জটিল হয়ে ওঠে। সুইজারল্যান্ডীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীফ্রিৎস স্ভিকি একটি গাণিতিক আদলের সাহায্যে মহাকাশের একটি ছায়াপথগুচ্ছের ("কোমা" ছায়াপথগুচ্ছ) সামগ্রিক ভর গণনা করতে গিয়ে দেখেন যে গুচ্ছটির সমস্ত দৃশ্যমান তারার যে সামগ্রিক ভর, তার চেয়ে গুচ্ছটির মোট ভর প্রায় ৪০০ গুণ বেশি। স্ভিকি এই অতিবিপুল ভরবিশিষ্ট অদৃশ্য পদার্থের নাম দেন "তমোপদার্থ"। তবে ১৯৫০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে অনেক পদার্থ দৃশ্যমান আলো বিকিরণ না করলেও খালি চোখে অদৃশ্য অবলোহিত ওবেতার তরঙ্গ বিকিরণ করে তাদের উপস্থিতির জানান দেয়। ফলে তথাকথিত "অদৃশ্য" পদার্থের বেশ বড় অংশই পরে আধুনিক বেতার প্রযুক্তির (বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র) মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
১৯৭০-এর দশকে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীভেরা রুবিনআকাশগঙ্গা ছায়াপথের ভেতরে ভরের বিতরণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন যে ছায়াপথের দৃশ্যমান পরিসীমার বাইরেও অনেক ভরযুক্ত পদার্থ ছড়িয়ে আছে, যে অঞ্চলকে "ছায়াপথের আভা" নাম দেওয়া হয়। ছায়াপথের দৃশ্যমান তারাসমূহের যে বিতরণ আছে, তাতে ছায়াপথের কেন্দ্রের তারাগুলি বেশি দ্রুত বেগে এবং কেন্দ্র থেকে দূরে পরিসীমার কাছের তারাগুলির অপেক্ষাকৃত কম বেগে আবর্তন করার কথা। কিন্তু রুবিন তারাদের গতিবেগ পরীক্ষা করে দেখেন একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের পরে তারাগুলি একই সমান বেগে ঘুরছে। এভাবেই স্ভিকির প্রাথমিক আবিষ্কারের কয়েক দশক পরে আবারও তমোপদার্থের অস্তিত্ব প্রমাণ হয়।
বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রায় সবাই একমত যে মহাবিশ্বের এক বিশাল অংশ “তমোপদার্থ” দিয়ে গঠিত। এটি কষ্টসাধ্যভাবে খুঁজে বের করতে হয়, এরকম সাধারণ পদার্থ থেকে আলাদা একটি পদার্থ। এই অদৃশ্য পদার্থ আলোর গতির উপর প্রভাব ফেলে না বা সাধারণ পদার্থের সাথে কোন ক্রিয়া করে না; কেবল মহাকর্ষীর প্রভাবের জন্য এগুলিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই তমোপদার্থের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্যাবলি এখনও উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হয় এগুলি তথাকথিত "দুর্বলরূপে আন্তঃক্রিয়াশীল ভরযুক্ত কণা" (Weakly interacting massive particle) দিয়ে গঠিত।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে মহাবিশ্বের আরেকটি উপাদান আবিষ্কৃত হয়, যার নাম দেওয়া হয়তমোশক্তি। এই তমোশক্তির কারণে মহাবিশ্ব দ্রুত থেকে দ্রুততর সম্প্রসারিত হচ্ছে। তমোশক্তির পরিমাণ এতই বিপুল যে এটি মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮% শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এর তুলনায় তমোপদার্থের শক্তি মহাবিশ্বের মোট শক্তির প্রায় ২৭% এবং সাধারণ পদার্থের শক্তি মহাবিশ্বের সামগ্রিক শক্তির মাত্র প্রায় ৫%।
সাম্প্রতিককালে একটিএকীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব নির্মাণের ব্যাপারে গবেষণার ফলাফল হিসেবে অতিপারমাণবিক কণিকাগুলির মধ্যে যে চার ধরনের আন্তঃক্রিয়া ঘটে, তাদের মধ্যে মহাকর্ষ বল বাদে অবশিষ্ট তিন ধরনের বলকে (সবল নিউক্লীয় বল,দুর্বল নিউক্লীয় বল,তড়িচ্চুম্বকীয় বল) একটিমাত্র ধারণাগত কাঠামোয় স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে পদার্থবিজ্ঞানীরা সম্ভবত ভরের উৎসের ব্যাখ্যার প্রায় দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন, যদিও একটি সম্পূর্ণরূপে সন্তোষজনক বৃহৎ একীভূত তত্ত্ব এখনও বের করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৯ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীশেলডন গ্লাসগো,আবদুস সালাম এবংস্টিভেন ওয়াইনবার্গ যে তড়িৎ-দুর্বল তত্ত্বটি প্রদান করেন, সেটিতেহিগস বোসন নামক একটি অতিপারমাণবিক কণিকার অস্তিত্ত্বের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। বলা হয় এই কণিকাটি সমস্ত জানা অতিপারমাণবিক কণাতে ভরের উৎস। এরপর বহু বছর ধরে অত্যন্ত শক্তিশালীকণিকা ত্বরকযন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর পরে ২০১২ সালে বিজ্ঞানীরা হিগস বোসনের সম্ভাব্য অস্তিত্বের ব্যাপারে ঘোষণা দেন।
দর্শনশাস্ত্রে পদার্থের প্রকৃতি সম্পর্কে মূলত চার ধরনের মতবাদ বিদ্যমান। এগুলিতে মূলত মন ও পদার্থের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে চতুর্বিভক্ত। দ্বৈতবাদ অনুযায়ী পদার্থ ও মন একে অপরের থেকে স্বাধীনভাবে বিরাজ করে, কিন্তু কোনওভাবে একে অপরের সাথে আন্তঃক্রিয়াশীল (আন্তঃক্রিয়া সমস্যা); দ্বৈতবাদ বলে যে মন, চেতনা, বুদ্ধিমত্তা ও সংজ্ঞান ভৌত বিশ্ব থেকে স্বতন্ত্র এবং এগুলিকে কোনও রকম ভৌত প্রক্রিয়া দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বস্তুবাদ বা ভৌতবাদ (এক ধরনের অদ্বৈতবাদ) অনুযায়ী মন বলে আলাদা কিছু নেই, সবকিছুই পদার্থ এবং পদার্থ ছাড়া মনের কোনও অস্তিত্ব নেই; মন, চেতনা, বুদ্ধিমত্তা, সংজ্ঞান, ইত্যাদিকে ভৌত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার (পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন, ইত্যাদি) মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আদর্শবাদ বা ভাববাদ (আরেক ধরনের অদ্বৈতবাদ) অনুযায়ী পদার্থ বলে কিছু নেই, সবই মন ও মনের ভেতরে অবস্থিত ধারণাগুচ্ছ; আমরা পদার্থ বলতে যা প্রত্যক্ষণ করি, মনের ভেতরে অবস্থিত কিছু ধারণাগুচ্ছ ছাড়া তার কোনও অস্তিত্ব নেই। সবশেষে নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদ অনুযায়ী বিশ্বের যা কিছু মানসিক বা বস্তুগত, তার সবই আসলে একটিমাত্র সারবস্তু দিয়ে গঠিত; পদার্থ ও মন একই সারবস্তুর দুইটি সরলীকৃত রূপ।
আধুনিককালে প্রায় সব বিজ্ঞানী এবং অনেক দার্শনিক ভৌতবাদ বা বস্তুবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু কোনও কোনও দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর মতে সামাজিক বিজ্ঞান,মনোবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান আপাতদৃষ্টিতে পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে গবেষণাকর্ম চালালেও এগুলির প্রতিটির একান্তই নিজস্ব ধারণা, তত্ত্ব ও সূত্র আছে, যেগুলিকে এর নিচের স্তরের শাস্ত্রটি দিয়ে সম্পূর্ণ এখনও ব্যাখ্যা করা হয়নি। যেমনজীববিজ্ঞানের সমস্ত ধারণা ও সূত্রকে কেবলমাত্র রসায়নবিজ্ঞানের ধারণা বা সূত্র দিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে ব্যাখ্যা করা হয়নি; ঠিক তেমনি রসায়নবিজ্ঞানের সব ধারণাকে এখনও পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা দ্বারা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। অনেক বিজ্ঞানী কেবল ধরে নিয়েছেন যে এইরূপ ব্যাখ্যা করা সম্ভব, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ব্যাপারটি হাতেকলমে সম্পূর্ণ প্রমাণ করে দেখাননি। যেমন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানীফ্রিম্যান ডাইসন লিখেছেন যে অন্য সব বিজ্ঞানের ধারণাকে কেবল পদার্থবিজ্ঞানে হ্রাস করা সম্ভব নয়। রসায়নশাস্ত্রের কিছু একান্ত নিজস্ব ধারণা আছে, যাকে পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। একইভাবে জীববিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞানের নিজস্ব অনেক ধারণা আছে, যেগুলি রসায়ন দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়; একটি মস্তিষ্ককে কতগুলি অণু পরমাণুর সমষ্টি হিসেবে চিন্তা করলে ভুল হবে।[২১] তাই কোনও কোনও দার্শনিকের মতে (যেমননোম চমস্কি) মন ও পদার্থের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে উপরোক্ত যেকোনও মতবাদ গ্রহণ করা নিরর্থক, কেননা আমরা মন বা পদার্থ সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি জ্ঞানলাভই করতে পারিনি।
মার্কিন দার্শনিক ওনিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপকটমাস নেগল প্রকৃতিকে অধ্যয়ন ও ব্যাখ্যা করার জন্য বর্তমান বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক মহলে ব্যাপকভাবে গৃহীত ভৌতবাদী, বস্তুবাদী, প্রকৃতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং এই যুক্তি দিয়েছেন যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের পর থেকে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানীদের অনুসৃত ভৌতবাদজীবন,মন,চেতনা,সংজ্ঞান,মূল্যবোধ, ইত্যাদির উৎপত্তি সংক্রান্ত মৌলিক প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভৌতবাদ অনুযায়ী প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনার কোনও পরম উদ্দেশ্য নেই। ভৌতবাদীরা বিশ্বাস করেন যে ডারউইনের বর্ণিতপ্রাকৃতিক নির্বাচন বহু লক্ষ-কোটি বছর ধরে কাজ করার ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি কোনও বুদ্ধিমান নকশাকারকের ইচ্ছায় পরম কোনও উদ্দেশ্যে ঘটেছে। কিন্তু নেগলের মতে বিজ্ঞানের যত পর্যবেক্ষণের সরঞ্জাম, পরীক্ষার প্রতিমান, গাণিতিক বর্ণনা আছে, সেগুলি কেবলমাত্র মৌলিক একটি স্তরে পদার্থ ও শক্তির বিভিন্ন ধর্ম ও গঠন ব্যাখ্যা করে; কিন্তু এগুলি থেকে মানুষের জীবনের সুখ, দুঃখ, চিন্তা, অনুভূতি, স্বাধীন সংকল্পশক্তি (স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের কর্ম নির্বাচন করার ক্ষমতা), ভালো-মন্দ মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ইত্যাদি অতিসাধারণ, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাগুলির উৎপত্তির কোনও "পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা" এখনও দিতে পারেনি। নেগলের মতে এই ব্যাপারগুলির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যাতে এটি সুস্পষ্ট করে দেখাতে হবে যে মন ও জীবনের উৎপত্তি কোনও হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়, বরং একটি প্রত্যাশিত ফলাফল। মহাবিশ্বে কীভাবে শুধুমাত্র পদার্থের দ্বারা ব্যাখ্যার অযোগ্য (materially irreducible) সচেতন মনের উৎপত্তি ঘটল, তা বিদ্যমানভৌত বিজ্ঞানগুলিতে --বিশ্বতত্ত্ব থেকে শুরু করেআণবিক জীববিজ্ঞান পর্যন্ত—পর্যাপ্তরূপে ব্যাখ্যা আজ অবধি করা হয়নি। সচেতন মন প্রকৃতির একটি মৌলিক দিক, আর প্রকৃতি বিষয়ক কোনও দর্শন যদি সেটির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা দিতে না পারে, তাহলে নেগলের মতে সেই দর্শন মৌলিকভাবে ভুল দিকে পরিচালিত। এর একটি কারণ হল আধুনিক বিজ্ঞান শুরু থেকেই পর্যবেক্ষণযোগ্য বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাবলির দিকে মনোযোগ দিয়েছে ও ব্যক্তিনিষ্ঠ মানসিক ঘটনাবলিকে এড়িয়ে গেছে। তাই মানসিক ঘটনাগুলিকে ভৌত বৈজ্ঞানিক সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে হোঁচট খেতে হয় এবংমন-দেহ সমস্যার সৃষ্টি হয়। আবার এর বিপরীতে বুদ্ধিমান কোনও পরম সৃষ্টিকর্তার নকশামাফিক বিশ্বের তত্ত্বও নেগল প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি নিরীশ্বরবাদী এবং জীবন, চেতনা ও মনের ব্যাখ্যার জন্য মহাবিশ্বের বাইরের কোনও সত্তার প্রতি দিকনির্দেশ করতে ইচ্ছুক নন। এই দুইয়ের পরিবর্তে নেগল প্রাকৃতিক পরম উদ্দেশ্যবাদ (Natural teleology) নামক একটি মতবাদে বিশ্বাসী, যা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক আরিস্তোতলের রচনায় পাওয়া যায়। এই মতবাদ অনুযায়ী প্রাকৃতিক বিশ্বের জীবন, চেতনা, যুক্তিবোধ ও মূল্যবোধ উৎপাদন করার অন্তর্নিহিত প্রবণতা আছে।[২২]
↑"Matter (physics)"।McGraw-Hill's Access Science: Encyclopedia of Science and Technology Online। ১৭ জুন ২০১১ তারিখেমূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মে ২০০৯।
↑কখগD. Majumdar (২০০৭)। "Dark matter — possible candidates and direct detection"।arXiv:hep-ph/0703310 [hep-ph]।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑K.A. Olive (২০০৩)। "Theoretical Advanced Study Institute lectures on dark matter"।arXiv:astro-ph/0301505 [astro-ph]।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑Helaine Selin, সম্পাদক (২০১৩), "Physics in China",Encyclopaedia of the History of Science, Technology, and Medicine in Non-Westen Cultures, Springer Science & Business Media, পৃষ্ঠা 815উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑Diana Steigerwald,Ikhwan al-Safa', Internet Encyclopedia of Philosophy, সংগ্রহের তারিখ 27 July, 2019এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:|সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑İbrahim Kalın; Salim Ayduz, সম্পাদকগণ (২০১৪),The Oxford Encyclopedia of Philosophy, Science, and Technology in Islam, Volume 1, Oxford University Press, পৃষ্ঠা 142উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑ডঃ আমিনুল ইসলাম (২০১৯),মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, মাওলা ব্রাদার্স, পৃষ্ঠা ১১৮উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑Isaac Newton,Mathematical Principles ofNatural Philosophy, trans. A. Motte, revised by F. Cajori (Berkeley: University of California Press, 1934), pp. 398–400. Further analyzed by Maurice A. Finocchiaro, "Newton's Third Rule of Philosophizing: A Role for Logic in Historiography",Isis 65:1 (Mar. 1974), pp. 66–73.