ছুংছিং[টীকা ১] (চীনা:重庆;ফিনিন:chóngqìng,আ-ধ্ব-ব: [ʈʂʰʊ̌ŋ.tɕʰîŋ];শুনুনⓘ), যাকে অতীতেচুংকিং নামেও ডাকা হত, গণচীনের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগের একটি শহর। এটি প্রাদেশিক মর্যাদাবিশিষ্ট ও সরাসরি কেন্দ্রশাসিত বৃহত্তর ছুংছিং পৌরসভার অন্তর্গত। বৃহত্তর ছুংছিং পৌরসভার মোট আয়তন ৮২০০০ বর্গকিলোমিটার। পৌরসভাটির পশ্চিমে সিছুয়ান প্রদেশ, উত্তরে শাআনশি প্রদেশ, পূর্বে হুপেই প্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্বে হুনান প্রদেশ ও দক্ষিণে কুইচৌ প্রদেশ। বৃহত্তর ছুংছিং পৌরসভাতে ২০১৫ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী ৩ কোটি লোকের বাস, যার মধ্যে ১ কোটি ৮৩ লক্ষ লোক পৌর এলাকাতে বাস করে। প্রায় ৮৫ লক্ষ লোক মূল ছুংছিং শহরের ভেতরে বাস করে। সমগ্র পৌরসভাকে শহর হিসেবে গণ্য করা হলে ছুংছিং চীনের বৃহত্তম শহর।[৮] তবে ছুংছিং পৌরসভার অন্তর্গত ফুলিং এলাকা, ওয়ানচৌ এলাকা ও ছিয়েনচিয়াং এলাকাগুলি বাস্তবপক্ষে নিজেরাই একেকটি শহর।[৯] ছুংছিং পৌরসভাতে ২৬টি প্রশাসনিক পৌরজেলা, ৮টি কাউন্টি ও ৪টি স্বশাসিত কাউন্টি আছে।
ভৌগোলিকভাবে ছুংছিং শহরটি দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের মধ্যভাগে ঊর্ধ্ব ছাং চিয়াং (ইয়াংসে) নদীর অববাহিকাতে অবস্থিত একটি প্রধান অভ্যতরীণ নদীবন্দর ও পরিবহন কেন্দ্র এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বাণিজ্য ও শিল্পকেন্দ্র। শহরটি ছাং চিয়াং ও চিয়ালিং নদীর সঙ্গমস্থলে, সমুদ্র থেকে ২২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ছুংছিং পৌরসভাতে সমভূমির পাশাপাশি পাহাড় ও পর্বতময় এলাকাও রয়েছে। পৌরসভার উত্তর-পূর্ব অংশে ছাং নদীর তিন গিরিখাত নামের সুদৃশ্য অঞ্চলটি অবস্থিত। মূল শহরকেন্দ্রটি দুই নদী দ্বারা আংশিকভাবে বেষ্টিত একটি শৈলান্তরীপের উপরে অবস্থিত। শহরটির কলেবর বৃদ্ধির সাথে এটি উভয় নদীর তীর ধরে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপশহর ও শিল্পশহর ছুংছিয়ের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।
ছুংছিং শহরের বর্তমান অবস্থানে ৪০০০ বছর আগেই একটি শহরের উপস্থিতি ছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এটি চীনের উত্তর ও মধ্য চীনের বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, আবার অন্য সময় এটি স্বাধীন একটি শহর ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে এটি ছিন রাজবংশের শাসনাধীন একীভূত চৈনিক রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়। মধ্যযুগে দক্ষিণা সুং রাজবংশের শাসনামলে (১১২৭-১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) ১১৮৯ সালে এটিকে ছুংছিং নামকরণ করা হয়, যার অর্থ "দ্বিগুণ পরিমাণে আশীর্বাদপ্রাপ্ত"। মিং রাজবংশের শাসনামলে (১৩৬৮-১৬৪৪) শহরটি একীভূত চীনা সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। ১৮৯০ সালে শহরটিকে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯১১-১৯১২ সালে যে বিপ্লবের ফলে চীনের শেষ রাজবংশের পতন ঘটে, তাতে ছুংছিং শহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; শহরের অনেক অধিবাসী বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চীন-জাপান যুদ্ধের সময় (১৯৩৭-১৯৪৫) এটি জাতীয়তাবাদী চীনের রাজধানী শহর ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ভারী জাপানি বোমাবর্ষণের শিকার হয়। ১৯৪৯ সালে দুই মাসের জন্য এটি চীনের রাজধানী ছিল। ১৯৫০-এর দশক থেকে শহরটির আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এখানে অনেক ভারী শিল্পকারখানা স্থাপন করা হয়। শহরটিকে ১৯৫৪ সাল থেকে সিছুয়ান প্রদেশের অধীনে আনা হয়। কিন্তু চার দশক পরে ১৯৯৭ সালের ১৪ই মার্চ তারিখে এটিকে প্রদেশটি থেকে পৃথক করা হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি শাসনের অধীনে নিয়ে এসে একটি প্রাদেশিক মর্যাদাবিশিষ্ট পৌরসভাতে উন্নীত করা হয়।[১০] এর আগে কেবল বেইজিং, সাংহাই ও থিয়েনচিনকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। সিছুয়ান প্রদেশের পূর্বভাগের এক বিশাল গ্রামীণ ভূখণ্ডকে ছুংছিংয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়, ফলে ছুংছিং অঞ্চলের আয়তন ও জনসংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এরপর অঞ্চলটিতে দ্রুত ও ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত এক বিবরণে ব্রিটিশ অর্থনৈতিক সাময়িকী ইকোনমিস্ট ছুংছিং শহরটিকে চীনের ১৩টি উদীয়মান মহানগরীর একটি হিসেবে চিহ্নিত করে।[১১]
ছুংছিং শহরটি একটি লৌহ আকরিক ও কয়লার মজুদ সমৃদ্ধ অঞ্চলের কাহে একটি উর্বর কৃষি অঞ্চলে অবস্থিত। এছাড়া এখানে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বক্সাইট খনিও আছে। এখানে লোহা, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, কৃষি ও ভারী শিল্পের যন্ত্রপাতি, মোটর যানবাহন, সূক্ষ্ম সরঞ্জাম, তুলা ও রেশমবস্ত্র, কাগজ, ময়দা, রঞ্জক, রাসায়নিক দ্রব্য, সার, ঔষধ ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের শিল্পকারখানা আছে। শহরটি সিছুয়ান, ইউন্নান, কুইচৌ ও শাআনসি প্রদেশগুলি ও স্বশাসিত তিব্বত অঞ্চলের জন্য বাণিজ্য ও পরিবহনের কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা রাখে। ছুংছিংয়ের নদীগুলি চীনের অন্যান্য অংশ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে প্রবেশের দ্বার হিসেবে কাজ করে এবং এগুলিতে প্রচুর মালবাহী জাহাজ চলাচল করে। ২১শ শতকের শুরুতে তিন গিরিখাত বাঁধ নির্মিত হবার পর থেকে ছাং চিয়াং (ইয়াংসে) নদী ধরে ৩০০০ টন ওজনের জাহাজও ছুংছিং শহরে ভেড়ার সুযোগ পেয়েছে। শহরটি রেলপথ ও মহাসড়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে চীনদেশের সমস্ত অংশের সাথে সংযুক্ত। এখানে দুইটি বিমানবন্দর আছে। শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার উত্তর অবস্থিত চিয়াং পেই বিমানবন্দরটির সাথে চীনের সব প্রধান শহর ছাড়াও ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ও সিউলের বিমান-সংযোগ আছে।
শহরের কেন্দ্রে জনতার চত্বর নামক পথচারী চত্বরটিতে গম্বুজবিশিষ্ট বিশাল "জনতার মিলনায়তন"টি দাঁড়িয়ে আছে। চত্বরের অপর পাশে তিন গিরিখাত জাদুঘরটিতে তিন গিরিখাত বাঁধের নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম ছাড়াও বেশ কিছু প্রাচীন শিল্পকর্ম আছে। শহরকে বেষ্টনকারী অঞ্চলে বেশ কিছু পর্যটনকেন্দ্র ও উষ্ম খনিজ পানির স্বাস্থ্যকর ঝর্ণা আছে, যেগুলির বয়স শতবছরেরও বেশি। সিছিখৌ গ্রামটি মিং ও ছিং রাজবংশের শাসনামলে চিনামাটির তৈজসপত্র নির্মাণের কেন্দ্র ছিল। এখন সেখানে অনেক চা-ঘর ও স্মারকদ্রব্যের দোকান আছে। ছুংছিংয়ের চিড়িয়াখানাতে দুর্লভ দানব পান্ডা ও লাল পান্ডার আবাস। চিয়েফাংপেই একটি ঝলমলে ও ব্যস্ত কেনাকাটার এলাকা যেখানে অনেক বড় বড় বিপণীবীথি আছে। হুয়াংচুয়েফিং গ্রাফিটি সড়কে অনেক চিত্রশালার পাশাপাশি সড়ক চিত্রকলার নিদর্শন রয়েছে। শহরের সর্বত্র রাস্তার পাশের খাবারের দোকানে ও রেস্তোরাঁগুলিতে হট পট বা গরম হাঁড়িতে ঝাল সিছুয়ান মরিচ দেওয়া বিভিন্ন আমিষ-নিরামিষ পদের রান্না পরিবেশন করা হয়। শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে তাৎসু নামক স্থানে প্রাচীন বৌদ্ধ ও তাওবাদী ঘরানার খোদাই করা শিলার কাজ পরিদর্শন করা যায়।
ছুংছিয়ের জলবায়ু মৃদু ও অত্যন্ত আর্দ্র। উত্তরের ছিন পর্বতমালার কারণে এখানে শীতকালে উত্তুরে হিমশীতল হাওয়া আসতে পারে না। সেসময় গড় তাপমাত্রা জানুয়ারি সর্বনিম্ন ৮°সেলসিয়াসে নেমে আসে। অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে আগস্ট মাসে তাপমাত্রা ৩৮°সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় এবং বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১৪০০ মিলিমিটার হতে পারে। কিন্তু বছরের বাকী সময় শহরটি শুষ্ক ও প্রায়শই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থাকে। সারা বছর ধরেই বায়ু দূষণ একটি বড় সমস্যা।
ছুংছিং উচ্চশিক্ষার একটি জাতীয় পর্যায়ের কেন্দ্র। এই পৌরসভায় প্রায় তিন ডজন বিশ্ববিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয় আছে। এদের মধ্যে ছুংছিং বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। প্রধান কিছু সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হল ছুংছিং গ্রন্থাগার ও চীনের তিন গিরিখাত জাদুঘর। ছুংছিং শহরে ম্যান্ডারিন চীনা ভাষার একটি দক্ষিণী উপভাষা প্রচলিত। এছাড়া এখানে ১০ লক্ষ থুচিয়া ও ৫ লক্ষ মিয়াও জাতির লোক বাস করে।
↑"Doing Business in China - Survey"। Ministry Of Commerce - People's Republic Of China। ২০১৪-০৫-২৬ তারিখেমূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৮-০৫।